
অন্যান্য দিনের মতো রাজামশাই রাতে বাড়িতে ফিরলেন। রাজপুত্রকে নিজের বিশ্রাম কক্ষে পেলেন না।
রানিমাকে বললেন-“কী ব্যাপার রানি ? আমার রাজপুত্র কোথায় ?”
রানিমা বললেন-“গোঁসা হয়েছে!”
রাজামশায় প্রমাদ গুনলেন। দেশের সমস্ত মানুষের শত সহস্র সমস্যা তিনি মেটান। অথচ তাঁরই আপন পুত্র তাঁর উপর রাগ করেছে ? তিনি তা জানেনই না! কী অত্যাশ্চর্য ব্যাপার! তিনি তো রাজপুত্রের হাসিমুখ ছাড়া কিছুই ভাবতে পারেন না! তিনি রানিমাকে বললেন-
কোথায় আমার রাজপুত্র
তাহার হাসিমুখ
ওই মুখেই লুকিয়ে
আমার সকল সুখ।
রানিমা পড়লেন মহাবিপদে। তিনি জানেন মহারাজার সকল কঠিন কঠিন কাজের সাফল্যের চাবিকাঠি রাজপুত্রের হাসিমুখ দর্শনে। কিন্তু রাজপুত্র সেই যে বাড়ি ফিরে গোমড়া মুখে বসে আছে তার আর অন্যথা নেই। তিনি অনেকবার বলেছেন, কিন্তু রাজপুত্রের মুখে রা নেই।রানিমা স্বয়ং চললেন। রাজপুত্রকে ধরে নিয়ে এলেন রাজার কাছে। অন্যান্য দিন রাজাকে দেখেই রাজপুত্রের মুখ হাসিতে ভরে যায়। দুজনেই উদগ্রীব হয়ে থাকে দুজনের জন্য। রাজা আজ একমুখ হেসে এগিয়ে এলেন। রাজপুত্রের মুখ গম্ভীর। কথাও নেই। হাসিও নেই। রাজা বললেন-
সোনা আমার যাদুমণি
কোথায় তোমার হাসি!
তোমার হাসি বলছি বাবাই
বড্ড ভালোবাসি!
রাজপুত্রের মুখ তবু গোমড়া। ঠোঁট তবু জোড়া! এবার রানিমা রাজপুত্রের কপালে একটা চুম্বন করলেন। রাজপুত্রের গোমড়া মুখ তবু গোমড়াই রইল। কিন্তু সে ঠোঁটদুটো অল্প একটু ফাঁক করে বলল-
রোদ চাই রোদ দাও
ঘরে ঘরে রোদ
রোদ দাও হাসি নাও
সব শোধবোধ!
রাজপুত্রের কথা শুনে রাজামশায় অবাক। হাঁ করে চেয়ে রইলেন তিনি। বলে কী তাঁর ছেলে ? তার রোদ চাই ? ঘরে ঘরে রোদ ? এ কী বলছে তাঁর একরত্তি ছেলেটা ?
রাজামশায়ের অবাক মুখপানে চেয়ে অবশেষে রানিমা বললেন-“রাজপুত্র আজো স্কুল থেকে ফিরে তার কৃষক বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরেই রাজপুত্রের মুখের হাসি গায়েব!আমিও তো বুঝতে পারছি না।”
আসলে হয়েছে কী রাজপুত্রকে রাজামশাই একশতভাগ স্বাধীনতা দিয়েছেন! তার যা ইচ্ছে করে সে তাইই করে। আর রাজপুত্রের সখগুলোও অদ্ভুত।সে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করে না। সে বিজ্ঞানের বই, সাহিত্যের বই, মহাপুরুষদের জীবনী এইসব পড়তে ভালোবাসে। রাজামশায় বাঁধা দেন নি। রাজপুত্র রাজ্যের সমস্ত কৃষকপুত্রদের সাথে মেলামেশা করে। রাজামশায় তাতেও আপত্তি করেন নি। কারণ এইসব করে রাজপুত্র খুশি ছিল। সবসময় তাঁর মুখে হাসিটি লেগেই থাকত। কিন্তু এখন তিনি এ কী দেখছেন?? তাঁর পুত্রের গোমড়া মুখ?? তিনি রাজপুত্রকে অনেক আদর করলেন। অনেক ভালো ভালো খবার নিয়ে সাধাসাধি করলেন। কিন্তু রাজপুত্র কিছুই খেলোও না মুখে তার হাসিও এলো না। তিনটি প্রাণী সারারাত ছটফট করলেন শুয়ে শুয়ে।
পরদিন সকাল হতেই রাজা মন্ত্রণাকক্ষে জরুরি মিটিং ডাকলেন। রাজার প্রধানমন্ত্রীর বুদ্ধি সকলের অবিদিত আছে নিশ্চয়ই। প্রধানমন্ত্রী বুদ্ধি দিলেন জেলেদের খবর দিতে। কেননা জেলেরা জাল দিয়ে জল থেকে মাছ ধরতে ওস্তাদ! আর রোদ তো জলে নয় ডাঙায় ভর্তি! রাজামশায় ভাবেন যে মন্ত্রী একদম ঠিক কথাই তো বলেছেন। সত্যি তো বাড়ির ছাদে, পুকুর ঘাটে, ফাঁকা মাঠে প্রচুর রোদ। একটু বুদ্ধি করে ধরতে পারলেই কেল্লা ফতে!
পরদিনই তিনি ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দিলেন-
শুনুন শুনুন জেলে ভাই সব
শুনুন দিয়া মন!
রোদ আনতে ঘরে ঘরে
সবার আমন্ত্রণ!
যেজন পারেন আনতে তারে
রোদ্দুর একখানা
অর্থ পাবেন দৌলত অনেক
আর সোনাদানা!
দেশে যত জেলে ছিল সব্বাই দলে দলে জাল নিয়ে রোদ ধরতে নেমে পড়ল। ভাবল এ আর এমন কী কঠিন কাজ। জলের থেকে ঝপাঝপ জাল ফেলে মাছ ধরি আমরা যেমন করে ঠিক তেমন করে মাঠে, ছাদে জাল ফেলব আর কপাৎ করে রোদের টুঁটি টিপে ধরে বন্দি করে ফেলব।
রাজামশায় বললেন-
গাছের তলায় পুকুর ধারে
কিম্বা কুঁড়ে ঘরে
যেথায় আছে যতো রোদ্দুর
ধরো আপন করে!
জেলেরাও জাল নিয়ে তৈরি। ফাঁকা মাঠ-ঘাট-ছাদ যেখানেই দেখো জেলেরা জাল নিয়ে তৈরি। আর তাদের রোদ ধরা দেখতে দলে দলে নগরবাসী তাদের পিছন পিছন চলছে। জীবনে তাদের জাল ফেলা যে এতো গুরুত্বপূর্ণ তা কখনোই মনে হয় নি। এখন জেলেরা নিজেদের অতি সৌভাগ্যবান মনে করছে। ভালো পোষাক পরেছে। চোখে রোদ চশমা লাগিয়ে, গোঁফ মোচড়াতে মোচড়াতে জেলেরা জাল ফেলছে। জালের তলায় থাকে লোহার কাঠি। শুকনো ডাঙায় ওই জাল ফেলার সাথে সাথে ঝনঝন করে আওয়াজ হচ্ছে। সেই আওয়াজে উৎফুল্ল দর্শকেরা চিৎকার করে নিজেদের আনন্দ প্রকাশ করছে। জেলেরা মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করতে ইঙ্গিত করছে। কেননা জালে প্রচুর রোদ ধরা পড়েছে। সব্বার মুখে খুশি চকচক করছে! কী অপূর্ব দৃশ্য! জাল ভর্তি রোদ! জেলেরা অতি সন্তর্পণে জাল গুটিয়ে আনছে! কিন্তু কী আশ্চর্য! জাল যত কাছে আনে, রোদ ততই দূরে পালায়! এক টুকরো রোদের ফালিও উঠল না কারো জালেই! একদিন দুইদিন তিনদিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। নাহ! রোদ ধরা দিচ্ছে না কিছুতেই! রাজা রেগে গেলেন! জেলেরা যুক্তি দিল-
শুনুন রাজা মহারাজা
বড্ড ফাজিল রোদ্দুর
খিলখিলিয়ে হাসে কেবল
জাল ফেলে যায় কদ্দুর!
রাজামশায় এমনিতেই ছিলেন রেগে। রোদ্দুরের হাসি আর পালিয়ে যাবার কথা শুনে গেলন মহা ক্ষেপে! বললেন-
খলবলানো মাছগুলো সব
আসে জালের মাঝে!
একফালিও রোদ আসে না
এতোই তারা বাজে!
জেলেরা আর কী বলে! ওরাওতো এমনই ভাবছে! এত্তো গাদা গাদা মাছ ধরে কপাৎ করে, অথচ এক টুকরোও রোদ ধরতে পারল না।
মুখ নিচু করে জেলেরা তাদের বিশেষ সাজ-পোষাক খুলে, রোদ ধরার রোদ চশমা খুলে যে যার কাজে লেগে পড়ল এবং দক্ষতার সাথে মাছ ধরতে লাগল।
এদিকে রাজার সমস্যা থেকেই গেল। রাজপুত্রের মুখের হাসি আজও ফেরেনি। শুধু তাইই নয়, রাজপুত্র এখন আর কোত্থাও যায় না। পড়াশুনাতেও অমনোযোগী। এমন কি তাকে খাওয়াতেও বেগ পেতে হচ্ছে।
রাজামশায় এবার ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দিলেন। তিনি এবার বললেন-
শুনুন শুনুন দেশবাসী
মজার কথা নয়
সবার ঘরে রোদের যোগান
রহিবে নিশ্চয়।
যে পারে এই যোগান দিতে
তারেই দিব মান!
আধেক রাজ্য তারই হাতে
করিব যে দান!
সমস্ত দেশবাসীর মধ্যে যেন ঝড় বয়ে গেল! রাজামশায় অর্ধেক রাজত্ব দান করবেন! এবার লোহার খাঁচা তৈরি করে রোদকে বন্দি করবে বলে একদল মানুষ রাজপ্রাসাদে এসে হাজির! তারা রাজামশাইকে বোঝালেন যে, জাল তৈরি হয় সুতো দিয়ে, তো সুতোর তৈরি জালে কখনো রোদকে বন্দি করা সম্ভব?? তারা প্রত্যেকেই রাজামশায়কে বলল-
রোদ আসলে সোনার মতো
তার থেকেও দামি
লোহার খাঁচায় ঠিক ধরিব
কথা দিলাম আমি!
রাজামশায় ভেবে দেখলেন। ঠিক, ঠিক। এ কথাটা কেন যে তাঁর আগে মনে হয়নি! রোদ কখনো সুতোর তৈরি জালে ধরা সম্ভব?? রাজপ্রাসাদে আবার নতুন করে লোহার খাঁচা তৈরির জন্য জনসমাগম হতে লাগল।
তৈরি হল স্পেশাল খাঁচা। তারপর মাঠে-ঘাটে-ছাদে সেই খাঁচা পেতে রাখা হল সক্কালবেলায়। একটু বেলা হতে না হতে প্রচুর রোদ সেই খাঁচায় ধরা দিল। উৎফুল্ল খাঁচার নির্মাতারা। তাড়াতাড়ি খবর গেল রাজার কাছে! রাজামশায় শুনে আনন্দে নেচে উঠলেন! রাজপুত্রকেও নিয়ে এলেন খাঁচা-বন্দি রোদ দেখাতে। রাজপুত্র খাঁচা ভর্তি রোদ দেখে আনন্দে হাততালি দিয়ে বলল-
আকাশ থেকে নেমে এলি
গ্যালন গ্যালন রোদ
বোকা বোকা তোরা অতি
ধরা দিলি খোদ!
রাজামশায় বললেন-
সোনার চেয়েও সোনা রোদে
খাঁচাখানি ভরা!
দুয়ার আঁটো, খাঁচা খুলে
নিয়ে এসো ত্বরা!
সেইমতোই খাঁচার দরজা ঝপাং করে বন্ধ করে দেওয়া হল। এবং যে যার খাঁচা হাতে তুলে প্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ করল। তারপর ধীরে, অতি ধীরে খাঁচার দরজাটি খোলা হল। আর ভিতরে তাকিয়েই সব্বার আক্কেল গুড়ুম!
খাঁচার ভিতর তরল আঁধার
রোদের দেখা নাই
নিজের চোখে দেখা রোদ্দুর
কোথায় গেলো ভাই ?
বলতে বলতে রজপুত্রের মুখ হাঁড়ি। সে ছলোছলো নয়ন দুই হাত দিয়ে ঘষতে লাগল। রাজামশায় বুঝতে পারলেন, তাঁর বুকের ধনের মন খারাপ হয়ে গেছে আবার! একটু আগের হাত তালি দিয়ে আনন্দ করা নিমেষেই উধাও। রাজপুত্র হঠাৎ ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল। এবং দৌড়ে অন্দরমহলে আশ্রয় নিল।
পরদিন রাজামশায় আবার মন্ত্রণালয়ের রুদ্ধ কক্ষে দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে সারাদিন কাটালেন। এবং সর্বসম্মতিক্রমে একটা সিদ্ধান্তও নেওয়া হল।
এখন রাজামশায় একশত ভাগ নিশ্চিত! এবারে তিনি সফল হবেনই। তিনি পরদিন ঘোষণা করলেন-
শুনুন শুনুন বিজ্ঞানীরা
শুনুন সবে বলি
রাজ্য দিয়ে বিজেতাকে
বনেই যাব চলি!
একটা কেবল ছোট্ট দাবি
আছে আমার মনে!
আকাশ হতে রোদকে ধরে
আনুন ক্ষণে ক্ষণে!
রাজ্যবাসীরা নতুন করে ভাবতে বসল। এমনিতেই দলে দলে দেশবাসী অকর্মণ্য হয়ে উঠেছিল। কেউ কোনো কাজ করছিল না। কথায় বলে” যার কাজ তারে সাজে, অন্যজনে লাঠি বাজে!” আর এখন বিজ্ঞানীরাও ভাবল তাঁরা পারবেনই। তাঁরা দলে দলে রাজপ্রাসাদে যেতে লাগলেন। রাজামশাইয়ের কোনো তাতেই আপত্তি নেই। বিজ্ঞানীরাও আদা-জল খেয়ে লাগলেন! বিশাল বিশাল যন্ত্রপাতি আসতে লাগল। রাতদিন ঝমঝম, ধমধম আওয়াজ হতে লাগল। রাজামশাইও দুইহাতে খরচ করতে লাগলেন। বিজ্ঞানীরা যা চাইছেন তাইই দেওয়া হচ্ছে। যেভাবেই হোক আকাশের রোদকে ঘরে বন্দি করতেই হবে। বিজ্ঞানীদের কাজ দেখে সব্বার তাক লেগে যাচ্ছে। রাজামশায়ও সময় পেলেই এসে বিজ্ঞানীদের কাজ দেখেন। ওদের সাথে নানারকম কথা বলেন। বিজ্ঞানীরা বলেন, যে তাঁরা যে মেশিন বানাচ্ছেন সেখানে প্রচুর রোদ রাখা যাবে। এত্তো বিশাল বিশাল মেশিনে একসাথে এক বছরের রোদও ধরে যাবে। শুনে রাজামশায় বলেন-“রোদ বেশিদিন ঘরে থাকলে পচে যাবে না তো ?” বিজ্ঞানীরা হাসলেন-” না,না রাজামশায়। রোদ পচবে কেন ? তবে মাঝে মাঝে জ্যোৎস্না খাওয়াতে হবে!” রাজামশায় অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। হাসতে হাসতে বললেন=” আচ্ছা, রোদ কি আমার রাজপুত্রের সাথে খেলা-ধুলো করবে ?”
বিজ্ঞানীরা বললেন-“আজ্ঞে মহারাজ। রোদের মন ভালো থাকলে সে বা তারা আপনার ছেলের সাথে খেলবে। পাশে বসে গল্প করবে!”
রাজামশায় এখন কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছেন, তাঁর পুত্র ভীষণ খুশিতে সবসময় হাততালি দিচ্ছে। আর তাঁর রাজপ্রাসাদের সব ঘরে রোদের ঝলক।
বিজ্ঞানীরা বললেন- “মহারাজ, আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার আছে। রোদ যেহেতু ভাঁজ করা যাবে, তাই আপনাকে একটা সাবধানবানীর উল্লেখ করছি। আপনি রোদ কেনা-বেচার জন্য একটা মার্কেটের ব্যবস্থা করুন। তাতে কী হবে, রোদ নষ্টও হবে না। আপনার মতো মেশিন তো আর ঘরে ঘরে থাকবে না। তাই আপনি নিজেই কর্মচারীদের সাহায্যে সেই বাজারে রোদ বিক্রয় করতে পারবেন। দেশি বিদেশি অনেক খরিদ্দার হবে আপনার! কথা শুনে রাজামশায় চিন্তিত হলেন। রোদের বাজার যদি করতে হয় তাহলে রোদের নিরাপত্তার কথাও ভাবতে হয়। কেননা, রাজ্যে চোর ডাকাত বাটপারের তো অভাব নেই! তিনি যুদ্ধকালীন তৎপরতায় নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ করার বন্দোবস্ত করলেন! আগে থেকে সাবধান হওয়াই ভালো। নইলে পরে পস্তাতে হতে পারে। কিন্তু একটা জিনিষ তিনি ভেবে পাচ্ছেন না কিছুতেই। রোদ বাজার হল, রোদের খরিদ্দারও হল কিন্তু রোদ বহন করা হবে কেমন করে?? বিজ্ঞানীরা অভয় দিলেন, চিন্তার কিছু নেই। বোতল বা ব্যাগে করেই রোদ বহন করা যাবে। পয়সা থাকলেই যার যতটুক ইচ্ছে রোদ কিনে ঘরে আনতে পারবে! রাজা বললেন-
রোদের বাজার বসে গেছে
রোদ না নেবে যদি
তোমার আমার ঘরের খোকা
কাঁদবে নিরবধি!
সব্বাই আনন্দধ্বনি দিয়ে উঠল হাসতে হাসতে! রাজপুত্রও আবার খুশি হয়ে উঠেছে। রাজামশায় মনে মনে ঠিক করেই রেখেছেন, তাঁর পুত্র সুস্থ হলেই তিনি আবার রাজকার্যে মন দেবেন! বিজ্ঞানীদের যদি রাজ্যপাট দিয়েই দিতে হয়, তো দেবেন! রাজ্য পরিচালনা তো তাঁকেই করতে হবে!
দীর্ঘদিন বাদে বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করলেন যে রোদ বন্দি করার মতো যন্ত্র তৈরি সমাপ্ত হয়েছে! রাজামশায় স্বয়ং দেখতে এলেন। কিন্তু যন্ত্র দেখে তাঁর আক্কেল গুড়ুম! এক একটা ঘরে এক একটা যন্ত্র। প্রতিটিই ছাদ ছোঁয়া। লম্বা-চওড়ায়ও বিশাল। বিপুল তার পরিধি।ঘরের দরজা দিয়ে সেই মেশিন বের হবে না কিছুতেই। রাজামশাই চিৎকার করে উঠলেন-
এ কেমন বুদ্ধু বিজ্ঞানী
এত্তোবড়ো যন্ত্র!
কেমন করে বাইরে নেবে
জানো কি তার মন্ত্র ?
বিজ্ঞানীরা সবাই সবার মুখের পানে চায়। কিছুতেই এই দরজা দিয়ে এই বিশাল যন্ত্র বাইরে নেওয়া সম্ভব নয়! রাজামশায় প্রচণ্ড রেগে গিয়ে সব বিজ্ঞানীদের রাজ্যের বাইরে বার করে দিলেন! এইটুক সাধারণ জ্ঞান নেই, অথচ তারা আবার রোদকে বন্দি করবার যন্ত্র বানায়?? রাজামশায় রেগে ফায়ার হয়ে চিৎকার করলেন-
দূর করে দাও বিজ্ঞানীদের
দেখতে চাইনে মুখ
আশা দিয়ে অভাগারা
ভাঙল আমার বুক!
রাজামশায়ের সুখ গেছে। সব আশায় তিনি জলাঞ্জলি দিয়ে হাহাকার করছেন। খাওয়া ঘুম তাঁর বন্ধ। কারণ এতোদিনে তিনি জেনে গেছেন যে রোদ ঘরে আনার কোনো উপায়ই তিনি করতে পারছেন না! আর তাঁর পুত্রও ঘরে রোদ না পেলে সুস্থ হবে না। তার মুখের হাসি গায়েব হয়েছে। তার খিদেও পায় না! রাজামশায় এইরকম যখন ভাবছেন, ঠিক সেই সময় রানিমা এলেন। বল্লেন-“রাজপুত্রের অবস্থা ভালো নয়। সে বিছানা থেকে মাথা তুলতেই পারছে না!”
রাজামশায় চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন-“কী কথা শোনালে তুমি রানি!”
রানিও কাঁদেন! কাঁদেন রাজা! এত্তোখানি বড়ো সাজা! কী এমন অপরাধ তাঁরা করেছিলেন ?
তাঁদের প্রাণপাখি যেন খাঁচা ছেড়ে উড়ান দেবে এমনই মনে হচ্ছিল। কাঁদছে রাজ্যবাসীও। তাঁরাও জেনে গেছে তারা অভিভাবকহীন হচ্ছে। ঠিক এমন সময় রাজদ্বারে এক ছোট্ট শিশুর আবির্ভাব ঘটল। সে সোজা রাজার কাছে গিয়ে বলল-“মহারাজ, রাজপুত্র কেমন করে সুস্থ হবে এবং ঘরে রোদ পাবে আমি তা জানি।”
রাজা অবাক হলেন। আনন্দিত হলেন!
তিনি প্রশ্ন করলেন-“তুমি কে বাছা ? বলো, কী করলে ঘরে রোদ আসবে আমি তাই করতে প্রস্তুত! যত টাকা লাগে আমি দেব!”
ছেলেটি বলল-“আমি কৃষকের ছেলে। আমার নাম দুলাল। রাজপুত্রের বন্ধু আমি!”
রাজামশায় তো পারলে তাকে বুকে তুলে নেন। তিনি বললেন-“বলো বাবা, কীভাবে তুমি আমার ছেলের আশা পূর্ণ করবে ?”
রানিমা বললেন-“এতোদিন আসোনি কেন ?”
দুলাল বলল-“আমার বাবা তো রোজই আসেন। আর রোজই আপনার দারোয়ান বাবাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন। আমার বাবা কতো অনুরোধ করেছেন! কতোবার বলেছেন, যে তিনি রাজপুত্রের অসুখ সারিয়ে দেবেন! সব্বাই আমার বাবাকে উপহাস করেছেন! আজ আমি জোর করে এসেছি। আমি এত্তো ছোট্ট যে আমাকে কেউ খেয়ালই করেনি!”
রানিমা দুলালকে বুকে তুলে নিলেন। বল্লেন-
কৃষক ছেলে কৃষক ছেলে
মনের কথা কই
রাজার ছেলের বন্ধু তুমি
আমরাও পর নই!
কৃষক ছেলে বলল-
কৃষক ছেলে হবার জন্য
ভয় পেয়েছি মনে
না জানি কী ভুল করেছি
রাজপুত্রের সনে!
রানিমা বললেন-“না,না বাছা। তোমার কোনো ভুল নেই!”
কৃষকপুত্র বলল-
নইলে আমার বন্ধু কেন
খায়না খাবার আর ?
মুখের হাসি কোথায় গেল ?
মুখটি যে আঁধার!
রাজমশায় বললেন- বলো হে ছোট্ট রাজকুমার! কী করলে রাজপুত্রের ঘরে রোদ পাওয়া যাবে ? কী করলে রাজপুত্র হাসবে ?
কৃষকপুত্র বলল-
বন্ধু যদি আমার সাথে
আমার বাড়ি যায়
দুদিন সময় নিলাম রাজা
সারিবে নিশ্চয়।
কথা শুনে রানিমা কৃষকপুত্রের মুখচুম্বন করলেন। তারপর কাঁদতে লাগলেন। কৃষকপুত্রকে কোল থেকে নীচে নামিয়ে দিয়ে বললেন-
বাছা আমার সোনার ছেলে
একটু সবুর করো
বন্ধু তোমার শুয়ে আছে
শরীর জ্বরোজ্বরো।
ছুট্টে গিয়ে তাকে নিয়ে
আসছি তোমার পাশে
রোগ বালাই সব যাবে ভেসে
কিম্বা যাবে ত্রাসে!
রানি একটু পরেই রাজপুত্রকে কোলে করে নিয়ে এলেন! কৃষকপুত্রকে দেখে রাজপুত্রের মুখে হাল্কা হাসি দেখা গেল। রাজা-রানি উভয়েই আশান্বিত হলেন। রাজপুত্র আবার আগের মতো সুস্থ হয়ে যাবে। আবার সে হাসবে।
কৃষকপুত্র বলল-
বন্ধু শোনো বন্ধু তুমি
আমার বাড়ি যাবে ?
কৃষক বন্ধুর গরিব খানা
পেটটি ভরে খাবে ?
রাজপুত্র বলল-
বন্ধু তোমার ঘরের ভিতর
বিশ্ব রোদের ঠাঁই
আর তো আমি কোনোখানে
দেখিতে পাই নাই!
বলতে বলতে দুই বন্ধু হাত ধরাধরি করে নাচতে লাগল! ঠিক এমন সময় বাইরে কীসের চেঁচামেচি।রাজামশায় উৎকর্ণ হতে না হতেই পরিচারক এসে বললেন-“এক অতি সাধারণ কৃষক রাজামশায়ের সাক্ষাৎপ্রার্থী।”রাজামশায় অনুমতি দিতেই এক দরিদ্র কৃষকের অনুপ্রবেশ। ইনিই দুলালের বাবা। মহারাজের কাছে এতোদিন তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি এই লজ্জায় রাজামশায় ক্ষমা চাইলেন! তারপর সকলে মিলে আনন্দ করে খাওয়া দাওয়া হল! রাজপুত্রের কোনো মন খারাপের ছিটেফোঁটাও দেখা গেল না! শুধু সে বারবার বলছিল তাদের, “বন্ধু তোমার বাড়ি চলো!”
রাজামশায় এবার কৃষককে জিজ্ঞাসা করলেন-“আপনার ঘরের ভিতর রোদ আছে ? মানে কেমন করে ধরেছেন ?”
কৃষক হো হো করে হেসে উঠলেন!
রাজামশায় বললেন-“হাসবেন না। আমার পুত্র তো ঘরের ভিতর রোদ চাই এই বায়না করে করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আজ দুলাল বাবা না এলে কী যে হত…!”
কৃষক বললেন-“এইজন্য বুঝি রোদ ধরার চেষ্টা চলছিল এতোদিন ধরে! আমি ভাবলাম, রাজার খেয়াল! আমি জানতে পারলে সব সমস্যা তো মিটেই যেত!”
রাজামশায় আবার বললেন-“আপনি কেমন করে ঘরের ভিতর রোদ ধরে রেখেছেন ?”
এদিকে রাজপুত্রও সমানে দুলালকে তার বাড়ি যাবার কথা বলছে। তো রাজমশায় শেষ পর্যন্ত নিজেও রাজপুত্রের সাথে চললেন। কৃষক তাঁর কুঁড়ে ঘরে রাজাকে নিয়ে ঢুকলেন!
মাটির ঘরের মাটির মেঝেতে সোনার মতো রোদ। খিলখিল করে হাসছে। লুকোচুরি খেলছে। চিকচিক করে রূপ তাদের ফেটে পড়ছে। সেই সোনার মতো বা সোনার চেয়েও মূল্যবান রোদের শরীরে রাজপুত্র এবং কৃষকপুত্র বসে খেলতে লাগল। ঘরে অন্য কোনো আলো নেই। অথচ ঘর সোনার চেয়েও ঝকঝক করছে! রাজামশায়ের চোখ ছলছল করে উঠল! রোদের উৎস খুঁজতে তিনি উর্ধমুখী হলেন এবং দেখলেন খড়ের ছাউনি বর্ষার জলে পচে গেছে। তাই খড় নেই জায়গায় জায়গায়! সেই শূন্য জায়গা দিয়েই সোনার চেয়েও মূল্যবান রোদ এসে মাটির ঘরকে স্বর্গ বানিয়ে তুলেছে। দুলাল হাসে। রাজপুত্র হাসে। রাজামশায়ের চোখে জল ছলছল করে। রাজপুত্র এই খড়হীন ফাঁকা ঘরেই সুখ খুঁজে পেয়েছে। এই ঘরেই কৃষক আর তার পুত্র সুখে দিনাতিপাত করে। অথচ এই ছিদ্রপথেই নিশ্চয়ই বর্ষাকালে জল প্রবেশ করে! মহারাজ শাসক হতে পারেন। ভালো মানুষ হতে পারেন। কিন্তু কৃষক বা কৃষক-পুত্র দুলাল বা রাজপুত্র- এদের মতো জীবনের সার খুঁজে নিতে পারেন নি! তিনি বললেন-” আজ থেকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমিও আসব এখানে। যে ঘরে রৌদ্র প্রবেশ করে সে ঘর তো স্বর্গ!”
Leave a reply